-->

কাঁচের ফ্রেম



- "..সেদিন তো বৃহঃস্পতিবারই ছিলো, তাইনা?"

আমার প্রশ্নের উত্তরে বরাবরের মত বোবাহাসি নিয়ে তাঁকিয়ে আছে ও...

আমার কিন্তু এখনো মনে আছে, সেদিন ছোট ছোট হাতদুটো নিজের হাতের মাঝে রেখে অবাক হয়ে তাঁকিয়ে ছিলাম। হালকা গোলাপি রঙের আঙুলগুলো খুব সাবধানে ছুঁয়ে দেখছিলাম।
কি নরম!

ছেলেটার নাম রেখেছিলাম রাকাত। নামটাও ও ঠিক করে রেখেছিলো। আমার নামের সাথে মিলিয়ে..
সুন্দর নাম না?

হ্যাঁ, নামটা সুন্দর...নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।

বারান্দার অর্ধেক কাঁচেঢাকা জানালায় বৃষ্টির ঝাঁপটা। ঘোলা কাঁচে বাইরের সব আবছা দেখা যাচ্ছিলো।
পাশেই একটা আমগাছ। ডালে একটা কাক ভিজে চুপ করে বসে আছে।
আর আমি বারবার ফিরে যাচ্ছি সেদিনের সেই হাসপাতালের কেবিনে। কেবিনে ছিলাম আমি, ও, আর আমার হাতের মাঝে রাকাতের হাত।

ডাক্তার এসে একবার আমার দিকে শুকনো হাসি দিয়ে তাঁকালো। আমিও বিনিময়ে হাসি দিবো কিনা ভাবতে ভাবতেই চলে গেলো ফের..
আমার চিন্তা ছিলো তখন, ছেলেটা কি আমার মত হলো? নাকি ও'র মত?
গায়ের রঙ মোটেও আমার না হলেও, আমার মত নাক হয়েছে। আর চেহারা???

আমি ছোট বাচ্চাদের চেহারা আলাদা করতে পারিনা। আমার কাছে সবই একরকম লাগে।

- "..ছেলেটা কি আমার মত হয়েছিলো?...আমি না confused.."

... ... ...


যেদিন প্রথম ও'র সাথে আমার দেখা হয়েছিলো সেদিনও খুব বৃষ্টি হয়েছিলো।
ক্যাফেটার নিচে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা হাত ধরে। আমাদের কাছে ছাতা ছিলোনা তাই।
শীতে আমি হালকা হালকা কাঁপছিলাম বলে, আমার দিকে চোখ গরম করে তাঁকিয়েছিলো ও...

ব্যস, এটুকুই মনে আছে আমার।
অনেক চেষ্টা করেও আর মনে করতে পারিনা এই ঘটনার আগে কি হয়েছিলো বা পরে।

দোলনচাঁপা।
ও'র নাম। আমি ডাকতাম দোপা বলে। যদিও ওর ডাকনাম দোলা।
কোথাও আমরা একসাথে বের হলে আমার ডানহাতটা ধরে রাখতো সবসময়।

একদিন রিক্সায় করে কোথায় যেনো যাচ্ছিলাম।
ও স্বভাবমত আমার ডানহাত ধরে বসে আছে। পাড়ার রাস্তা।
এক ছেলে আমাদের হাত ধরে থাকা দেখে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেছিলো।
ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগায়, হাতধরা নিয়ে ওকে বকা দিয়েছিলাম।

বাচ্চাদের মত চোখ লাল করে কান্না করেছিলো খুব।
কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে আলুরচপ বানিয়ে ফেলেছিলো।

আমার এখনো মনে আছে,
সেদিন টং দোকান থেকে আলুরচপ কিনে ঠোঙাটা হাতে নিয়ে ওকে বলেছিলাম,

- "আলুরচপ খাবেন?..কেঁদে তো চোখগুলোকে আলুরচপ বানিয়ে ফেলেছেন.."

এটা শুনে ও হেসে দিয়েছিলো।
চোখে পানি, ঠোঁটে হাসি নিয়ে আমার কাঁধে আদুরেভঙ্গিতে মাথা রেখে সেই আলুরচপ খেয়েছিলো।

সব মনে আছে,
কেবল মনে নেই ওই প্রথমদিন দেখা হওয়ার কথাগুলো!
কেনো ওইগুলো মনে পড়েনা আমার??
... ... ...


দোপার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিলো অদ্ভুতভাবে।

এক দুপুরে হুট করে আমার বাসায় কাপড়ের ব্যাগ হাতে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিলো,

- 'চলেন..'
- "কোথায়?.."
- 'মুন্সিপাড়া রোডের ওইদিকে..'

আমার পরনে ছিলো সাদা-কালো স্ট্রাইপের একটা ট্রাউজার আর হালকা নীল এর একটা শার্ট। কেবল গোসল করে বের হয়েছিলাম তো তাই।
সেইভাবেই হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো ও..

কোর্ট-ম্যারিজ করেছিলাম আমরা।
স্বাক্ষী ছিলো ওর দুই বান্ধবী আর এক দূরসম্পর্কের মামি।

আমার এখনো মনে আছে সেইদিন সন্ধ্যায় আমরা প্রথম একসাথে হাত ধরে মেইনরোডের হলুদ ল্যাম্পপোস্টের নিচে হেটেছিলাম।

দোপা ছিলো পাগলীটাইপের মেয়ে..
আর আমিও ছিলাম ও'র পাগল।

ছিলাম বলছি কেনো এখনো আছি।
কেবল বয়সটা একটু বেড়েছে,
বেড়েছে মোটা ফ্রেমের চশমায় পাওয়ারটা।
 ... ... ...


এই বিচ্ছিরি বৃহঃস্পতিবারটা এলেই আমি এলোমেলো হয়ে যাই।
ফিরে যাই বারবার সেইদিনের হাসপাতালের কেবিনে।

বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠে আমার হাতের মাঝে রাকাতের ছোট ছোট দুটো হাত।

সেই ছোট্ট রাকাতের আজ ১৮তম জন্মদিন।
১৮ বছর...অনেকটা সময়।
তবু এখনো স্পষ্ট কানে ভাসছে ডাক্তারের কথাগুলো,

- "উই আর ভেরি সরি...অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারলাম না আমরা.."

একটা এক্সিডেন্ট।
আমার রাকাত সেদিন জন্মেছিলো ঠিকই। কিন্তু বেঁচেছিলো অল্পকিছু সময়ের জন্য।
ডাক্তাররা চেষ্টা করেছিলো লাইফ-সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার।
পারেনি...

কেবিনের রুমে বসে মৃত ছেলের হাত হাতে নিয়ে এক মুগ্ধ বাবার বসে থাকার দৃশ্যটা সেদিন কেউ কাঁচের ফ্রেমে বন্দি করেনি।

কিন্তু আমি বন্দি করেছি আমার দোপাকে...

ওই যে, আমার পাশে বোবাহাসি দিয়ে তাঁকিয়ে আছে ফটোফ্রেমের ভিতর থেকে।

- "..কি ব্যাপার? আজ আপনাকে ঝাপসা লাগছে কেনো?..."

... ... ...

বাইরে বৃষ্টিটা থেমেছে মনে হয়।
আজ একটু বাইরে হাঁটতে যাবো।

- "..কেউ কি আছো??..প্লিজ আমার চশমাটা এনে দাওনা! ওই টি-টেবিলেই তো রেখেছিলাম..খুঁজে পাচ্ছিনা কেনো??..

আছো কেউ?
প্লিজ, আমার চশমাটা এনে দাও..."


... ... ...

তারিখ: ৬১০২/৭০/২২.
লেখা: রোড নং ছত্রিশ!