যখন ভালোবাসারা পৌছায়
... ... ...
আমি বেশ ভালো করেই জানি প্রণয়ের প্রণালী...
তখন আমি হাইস্কুলে।
যদিও তখনও প্রেমের হাওয়া গায়ে এসে লাগেনি
তবু ভুল করে কোনো এক রাতে যদি আমার ড্রয়িংরুমে ভালোবাসা এসে পৌছায়,
আমি একদেখাতেই তাকে চিনে নেবো।
আমি একদেখাতেই তাকে চিনে নেবো
তার গলায় দেয়া কাঠের লকেটটা দেখে।
আমি একদেখাতেই তাকে চিনে নেবো
তার দীঘল চূলের বেণি দেখে।
আমি জানিই সে খুব ভালো পিয়ানো বাজাতে জানে,
আমার প্রিয় 'চন্দ্রবিন্দু'র সবকটি গানও নিশ্চয়ই তার মুখস্ত!
আমার সাথে রিকশায় চড়তে মোটেও সে ভয় পাবেনা ঠিক,
এবং আমি জানি...
কেবল আমি ভুল ক্লাসরুমে উঁকি দিয়ে তাকে খুঁজছি,
ভুল বারান্দায় ঢু দিচ্ছি তার জন্যে হয়তো।
আমি জানি এখানেই,
এই আশেপাশেই কোথাও সে লুকিয়ে আছে,
আমার শুধু প্রয়োজন তাকে খুঁজে বের করা।
... … …
কিন্তু অবশেষে যখন ভালোবাসা এসে ধরা দিলো আমার ড্রিমক্যাচারে,
আমি অবাক হয়ে দেখলাম
তার চুল উস্কোখুস্কো, এলোমেলো।
একই জামা রোজ রোজ গায়ে চাপিয়ে বেড়াচ্ছে সে পুরোটা সপ্তাহ।
রিকশায় চড়তে তার ভীষণ বিরক্তি,
'চন্দ্রবিন্দু' দূরে থাক, পিয়ানোর "প"-টাও সে ছুঁয়ে দেখেনি কখনো।
বরং
প্রতিবার চুমু খেতে গেলেই তার বেড়ে ওঠা অবাধ্য নাক,
আর কিড়কিড়ে দাতগুলো আমাদের মাঝে এসে বাগড়া জমায়।
তবু ধীরেধীরে এই ভালোবাসার জন্যেই আমি শুরু করলাম ঘরে মিথ্যে বলা।
- "মা একটু শর্মিলার বাসায় যাচ্ছি...ফিরতে সন্ধ্যে হবে"
অথচ প্রেমিক আমার বেজায় ভীতু
হাত ধরে রাস্তায় হাটতেও তার ভীষণ লজ্জ্বা!
তবে চোখদুটো দিয়ে ঠিকই সারাক্ষণ এদিকসেদিক তাঁকিয়ে সুযোগ খোঁজে,
খোঁজে এক চিলতে ফাকা গলি,
আর পেয়ে গেলেই টুক করে বা গালে হামি দিতে তার ভুল হয়না কখনোই।
এবং এভাবেই ভালোবাসা বাড়তে থাকলো,
ট্রেম্পোলিনের মত বিস্তৃত হতে লাগলো আমার চারিদিকে টেনেটুনে।
একইসাথে ভালোবাসা বদলাতে লাগলো
হারিয়ে যেতে থাকলো...আস্তে আস্তে।
অনেকটা দুধে দাত যেমন,
খুব দরকারী অংশ ভাবাসত্বেও হারিয়েছিলাম ৮ বছর বয়সে!
ভালোবাসা অদৃশ্য হয়ে গেলো অদক্ষ জাদুকরটার ভেলকির মতো করে,
উপস্থিত সবাই লুকানো দরজাটা দেখতে পেলেও
পাইনি কেবল আমিই।
আর এভাবেই দূরে সরে গেলো সে
অনেক বছরের তফাতে।
… … …
পরেরবার যখন পুনরায় ভালোবাসাকে পেলাম,
তাকে চিনে নিতে আমার বেশ কষ্টই হলো।
তার গায়ের গন্ধ বদলেছে,
পরেছে চোখের নিচে কালশিটে।
আমার সামনে বয়সের ভাজ মুখে নিয়ে দাড়ানো মানুষটাকে,
চিনতেই পারিনি একদম!
নতুন জন্মদাগ,
আরোও ভরাট গলার স্বর
ঘুমের অভ্যেসটাও বদলেছে নাকি!
বদলেছে পছন্দের বইয়ের তালিকা।
সে এখন রবীন্দ্র শোনে খুব, ওতে নাকি তারও মনে জাগে বিস্বাদ অন্য কাউকে ভেবে।
অথচ একসময় সে এসব শুনতোই না,
শুনতাম না তো আমিও...
তবুও আমরা পার্কের বেঞ্চ খুঁজে নিয়ে বসে গেলাম স্বাচ্ছন্দ্যেই।
গলা ছেড়ে হাসলাম নিজেদের বলা চটকদার কৌতুকে।
এবং সে নিজহাতে বানানো তালের বড়া বানিয়ে আনে আজকাল
হয়তো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে তারও ক্ষিধে পায়।
ইনসমনিয়াক হয়ে যায়নি তো!
কে জানে? হতে পারে...
আজকাল সালোয়ার বাদ দিয়ে শাড়িতে থিতু হয়েছে বেশ,
তবে চুপিচুপি জানিয়েছে এখনো কালেভদ্রে মাঝরাতে ডিমলাইট জ্বালিয়ে আয়নার সামনে ব্যাকলেস টপ্স আর কড়া লিপস্টিক মাখে জম্পেশ।
আজকাল সিদ্ধান্ত নিতে বেগ পোহায় না ভালোবাসা,
লাগেনা কারোও পরামর্শ অতটা।
বেশ বুঝলাম
আমার ভালোবাসা হয়ে গেছে প্রবীণ!
আগের মত অতটা সরল নেই আর।
আজকাল কথায় কথায় "ধুরবাল" শব্দে তার মুখ আঁটকায় না, সামনে আমার বাবা থাকাসত্ত্বেও।
বেশ শব্দ করেই মুখের খাবার চিবোয়,
সকালের টুথপেস্টের মুখটাও লাগায়না ঠিকমত।
আজকাল তার চ্যাটে স্মাইলি ইমোজির ব্যবহার বেড়েছে লক্ষনীয়ভাবে
এবং বুঝলাম,
ধীরে ধীরে এই ভালোবাসাটায় পঁচন ধরেছে!
… … …
তবে ভালোবাসারা কাঁদতেও জানে খুব।
কেঁদেকেঁদে মায়াভরে বলে,
"জানো? তুমি খুব সুন্দর!"
এবং তা মন থেকেই বলে প্রতিবার, আমি বুঝি।
বার বার বলতে থাকে, -"জানো, তুমি খুব সুন্দর!"
যখন তুমি ঘুম থেকে ওঠো, - "জানো? তুমি খুব সুন্দর!"
যখন তুমি মাত্র কান্না থামালে, - "জানো? তুমি খুব সুন্দর!"
যখন তুমি শুনতে শুনতে বিরক্ত, - "জানো? তুমি খুব সুন্দর!"
যখন তুমি বিশ্বাসও করতে চাওনা আর, - "জানো? তুমি খুব সুন্দর!"
যখন আর কেউ তোমাকে বলেনা, - "জানো? তুমি খুব সুন্দর!"
ভালোবাসারা তখনও কানের পাশে ইনিয়েবিনিয়ে বলতে থাকে...
- "জানো? তুমি খুব সুন্দর!"
তবুও ভালোবাসারা কখনোই মনের মত হতে পারেনা এবং
অনেকসময়ই বলতে ভুলেই যায়,
যখন তোমার খুব করে জড়িয়ে ধরে শুনতে ইচ্ছে করে, "তুমি খুব সুন্দর!"
… … …
কখনো ভুলে যেওনা,
ভালোবাসা ওটা নয় যেটা তুমি খুব করে ভাবছো,
ভালোবাসা সেটাও নয় যেটা তুমি কল্পনায় বসিয়ে হাসছো।
হয়তো ভালোবাসারা এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সোডিয়ামের শহরের বিছানায়,
আর তুমি লালচোখে জেগে আছো ভিন্ন কোথাও সস্তায়।
হয়তো ভালোবাসারা সবসময়ই আবর্তিত কারোও শেষ কক্ষপথে।
হয়তো ভালোবাসারা আমাদের যোগ্যই হয়ে উঠতে পারেনা,
হয়তো আমরাই যোগ্য হতে পারলামনা ভালোবাসার।
হতেই পারে সব ভালোবাসাই বিয়েতে এসে ঠেকবেনা,
হতে পারে পরেরবার যখন আমরা মুখোমুখি হবো বিশ বছরের তফাতে,
দুজনেই ডিভোর্সড।
ভালোবাসা হয়তো তখন বুড়িয়ে যাবে,
কিন্তু তখনো আগের মতই সুন্দর।
হয়তো ভালোবাসা থাকতে পারে মাসের ৩০দিনের জন্য,
দেখা হতে পারে কোনো বন্ধুর জন্মদিনের আড্ডায়,
ব্যস্ত আতশবাজিতে,
কিংবা হাসপাতালে পাশের বিছানায়।
হয়তো সে থাকলো,
হয়তো সে থাকলোনা,
হয়তো তাদের না থাকাটাই সবচেয়ে ভালো আমাদের জন্যে।
ভালোবাসা ঠিক তখনই আসবে যখন তার আসার প্রয়োজন মনে হয়,
এবং ভালোবাসা ঠিক তখনই চলে যাবে যখন তার যাওয়ার খুব দরকার।
যখন ভালোবাসারা এসে পৌছায়,
কাছে টেনে মৃদু অভ্যর্থনায় বলিও,
- "অবশেষে এলেন মহাশয়! কষ্ট হয়নিতো?"
আর যখন ভালোবাসা চলে যেতে চায় আঁটকানোর দরকার নেই,
কেবল যেনো যাওয়ার সময় দরজাটা পেছনে খোলা রেখে যায় একটু।
সাউন্ডসিস্টেমে গানটা বন্ধ করে চুপ করে বসে,
অবিচ্ছিন্ন নীরবতাগুলো উপভোগ করতে করতে আওড়াবো,
- "কৃতজ্ঞ! খুব কৃতজ্ঞ, আমার জীবনে খানিক এসে জিরোনোর জন্য"
... ... ...
(ভাবান্তর)
তারিখঃ ৯১০২/৭০/৫২
লেখাঃ রোড নং ছত্রিশ.
লেখাঃ রোড নং ছত্রিশ.
Post a Comment