স্বচ্ছ সিরিজের - আমি এবং কিছু অদ্ভুতুরে রাত
আধা কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেলো কোন ফিসফিস কন্ঠ শুনে।
ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেলেও, চোখটা বন্ধ করে বসে আছি।
উদ্দেশ্য, আমি কোথায় আছি সেটা মনে করা।
মনে পড়েছে,
আমি বাওয়া স্কুল এন্ড কলেজের বিপরীতে অবস্থিত যাত্রি ছাউনিতে বসে আছি।
কিন্তু এত রাতে ফিসফিস করবে কে কানের কাছে??
কান খাড়া করে রাখলাম।
হে, ফিসফিসানি এবার হালকা স্পষ্ট হয়েছে,
কোন এক ভরাট কন্ঠ বলছে,
- 'ভাইসাব...ও ভাইসাব!...'
পাত্তা দিলাম না।
যতটুকু মনে পড়ে, আমার আশেপাশে এক পাগল থাকার কথা।
কন্ঠটা আবার ডাকলো,
- 'আমি জানি ভাইসাব, আপনে শুনতাছেন!'
এবার চোখ খুলে তাকালাম!
নাহ্ আমার ধারণা ভুল।
সাফারি পরিহিত এক ভদ্রলোক আমার কানের কাছে মুখ এনে ডাকছে আমাকে!
আমিও মুখটা তার কানের কাছে নিয়ে গিয়ে বললাম,
- 'জ্বী বলুন জনাব!'
ভদ্রলোক তড়াক করে একহাত পিছিয়ে গেলেন।
হয়তো এই হঠাৎ ফিসফিসানো উত্তরটা তিনি আশা করেননি।
যাহোক, দেখলাম ভদ্রলোকের পাশে একটা চাকায় টানা সুটকেস।
ভদ্রলোকের চোখে রিম লাগানো ভারি চশমা।
প্রায় মিনতির স্বরে তিনি বললেন,
- 'ভাইসাব, আমার ব্যাগে ৩০লক্ষ টাকা আছে। আমি টাকাগুলো আপনার কাছে এক ঘন্টার জন্য রেখে যেতে চাই। এক ঘন্টার মাঝে আমি ব্যতিত অন্য কেউ এসে কিছু জানতে চাইলে, বলবেন এটা আপনার ব্যাগ। ওকে?'
আমি কোন উত্তর না দিয়ে পাশ ফিরে বসে পুনরায় ঘুমানোর প্রস্তুতি নিবো বলে ভাবছি।
আর একটু আগের বক্তব্যটা সুখস্বপ্ন মনে করে ভুলে যাওয়ার প্ল্যান করছি!
নিশ্চয়ই এটা কোন ভারতীয় সিরিয়াল নয়, যে হুট করে কেউ ৩০লক্ষ টাকা এনে হাতে দিয়ে চলে যাবে?
সবই কপাল!
একটু পর আবার ফিসফিসানি!
নাহ্ ব্যাপারটা তাহলে সত্যিই ঘটছে।
আমি হাই চাপতে চাপতে জবাব দিলাম,
- 'যদি আপনি আর ফেরত না আসেন তবে?'
প্রশ্নটা শুনে জনাবের কপালে চিন্তার রেখা দেখতে পেলাম।
এই শীতের রাতেও তিনি পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন।
উত্তরের অপেক্ষা না করে, স্যুটকেসটা নিজের কাছে টেনে চাদরের তলায় ঢেকে রাখলাম।
ভদ্রলোক খানিক ভেবে মানিব্যাগ থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে এগিয়ে দিলেন।
- 'আমি না এলে টাকাটার অর্ধেক এই ঠিকানায় পৌছে দিবেন। বাকি অর্ধেক রেখে দিবেন নিজের কাছে!'
বলেই হাটা দিলেন।
... ... ...
ঘুমটা ভেঙে গেছে।
চুপচাপ বসে আছি অজানা আগন্তকের অপেক্ষায়।
জনাব বলে গেছে, তিনি ব্যতিত অন্য কেউ আসতেও পারে।
যদি তাই হয়, তাহলে সেই একজন আশেপাশেই আছে।
আমি চোখ বন্ধ করে থাকি!
রাত আনুমানিক ২টা হবে।
ভদ্রলোক গেছেন দেড় ঘন্টা হতে চলেছে।
যদিও এইটাও আনুমানিক সময়।
এই সময়ের ভিতর কেউই এলোনা।
কি আর করা?
হাতল টেনে স্যুটকেসটা নিয়ে হাটতে শুরু করলাম।
যদিও এই মূহুর্তে যে কেউ এসে ব্যাগটা ছিনিয়ে নেয়ার সম্ভাবনা প্রচুর তবু হাটছি।
হাটতে হাটতে ২নং গেইটের কাছে এলাম।
আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খোজার চেষ্টা করলাম।
এবার স্যুটকেস নামিয়ে তার উপর বসে হাইওয়ের পাশের বিলবোর্ডগুলো পড়া শুরু করেছি।
একটু বাদে, ফিনফিনে গড়নের এক মেয়েকে আমার দিকে আসতে দেখলাম।
কাছে এসেই বললো,
- 'একলা নাকি?'
- 'হুম।'
- 'এই শীতের রাইতে বাইরে থাকলে হৈলে অসুখ বাধবো। আমার লগে আহেন, গরম কইরা দি।'
তাকিয়ে দেখলাম, সালোয়ার- কামিজ পড়া।
বয়স আনুমানিক ১৮ বা ১৯ ছুইছুই।
চেহারাটা বেশ ভালোই।
অনেকটা ইলিয়ানা ডি'ক্রাজের সাথে মিল!
বললাম,
- 'এত রাতে এই পাতলা জামাটা গায়ে দিয়ে আছো শীত করছেনা? নাও চাদরটা গায়ে দাও।'
কথা শুনে তার ভিতর কোন পরিবর্তন এলোনা।
সে নির্বিকার ভাবে বললো,
- 'বুঝছি আমারে আপনার মনে ধরেনাই। রেইট কিন্তু বেশিনা! আপনের নাগালেই পাইবেন।'
- 'আচ্ছা, সে হবে ক্ষণ। বসো তোমার সাথে ক্ষাণিক কথা বলি। তো নাম কি তোমার?'
বলে ফুটপাথে বসে গেলাম।
সে তখনো দাড়িয়ে।
বুঝতে পারছেনা কি করবে!
খানিক ভেবে পাশে বসতে বসতে বললো,
- 'রুম্পা।'
- 'আচ্ছা, তোমার রেইটটা কত যেনো?'
- 'হাফ নাইট ৫০.ফুল নাইট ১২০ সাথে রুমভাড়া ফিরি। তয় আপনারে আমার মনে ধরছে, যান আপনে ১০০ দিয়েন।'
- 'তার আগে চলো কিছু খেয়ে আসি।'
বলে স্যুটকেসটা টেনে হাটতে লাগলাম।
রুম্পা এবার একটু ঘাবড়ে গেছে মনে হয়।
দাড়িয়ে রয়েছে চুপ করে।
'কই আসো?' বলে হাতটা ধরে টান দিলাম আস্তে।
ঝট করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কাপাকাপা গলায় বললো,
- 'আপনে কি আমারে লইতাছেন?তাইলে আগে হাফ পেমেন্ট করেন।'
আমি হেসে তার হাতে ১২০টাকা ধরিয়ে দিলাম।
তবু যেনো তার সংকোচ কাটেনা!
বিগত ১০মিনিট যাবৎ রুম্পা আর স্যুটকেসটা নিয়ে খাবারের দোকান খুজে চলেছি।
কোথাও পেলাম না।
অবশেষে হাটতে হাটতে সেই আগের ছাউনিতে গিয়ে বসলাম।
রুম্পা ইতিমধ্যে বিরক্তির চরমে পৌছে গেছে।
কাস্টমার ভাড়া করবে...কাজ করবে...পেমেন্ট করে চলে যাবে!
এটাই স্বাভাবিক।
তবে আমার আচরণে প্রথম প্রথম ঘাবড়ে গেলেও এখন পাগল টাইপ কিছু ভেবে চুপচাপ উসখুস করছে।
- 'আপনার ঐ ছুটকেচে কি আছে?'
- '৩০লক্ষ টাকা। ১৫লক্ষ আমার, বাকিটা অন্য কারোও।'
- 'ও..'
কথাটা এমনভাবে ঠোট উল্টিয়ে বললো, যেনো কেউ তার ফাটা ঠোটে লেবু আর লবণ লাগাই দিছে।
এমন বিরক্তির কথা সে যেনো আগে কোথাও শোনেনি!
- 'আপনে কি হারাডা রাইত এইরাম করবেন? কিছু করলে চলেন, আর না করলে বিদায় দেন।
অন্য কাস্টমার ধরি!'
আমি কিছু বললাম না, চাদরটা কেবল আরেকটু আটসাট করে জড়িয়ে নিলাম।
রুম্পা উঠে চলে গেলো।
রুম্পারা বাস্তবের সামনে বন্দি।
এই নিশাচারীনিরা ভালো করেই জানে, ঠিক মতো কাস্টমার না পেলে কাল সকালে খাবার জুটবেনা।
চাইলেই তারা, সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এই শীতের রাতে কম্বলের নিচে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারেনা!
হাত বাড়িয়ে নিজের অধিকার আদায় করতে পারেনা!
তাদের হাত অপবিত্র।
সামাজীক পবিত্রতার ভীড়ে রুম্পাদের কোন ভবিষ্যৎ থাকতে নেই।
... ... ...
সকাল ১০টা।
শান্তির হোটেলে বসে ডালপুরি/চা খাচ্ছি।
আজ সারাদিনে অনেক কাজ আছে।
তালিকা নিম্নরুপ:
- ২নং গেইটে যেতে হবে।
- সিরিয়াল অনুযায়ী মেসে আজ টয়লেট পরিষ্কার করতে হবে।
- ভিজিটিং কার্ডের ঠিকানায় ঢুঁ মেরে আসতে হবে।
- বন্দর থানায় গিয়ে একটা ব্যপার ক্লিয়ার করতে হবে।
প্রথমেই থানাতে।
থানায় গিয়ে সেকেন্ড ইন কমান্ড কে পেলাম।
কাছে গিয়ে বললাম,
- 'জনাব, আপনার কাছে একটা আইনি ব্যপার ক্লিয়ার করতে এলাম। যদি আপনার সময় হয়।'
- 'আমাকে দেখে নিশ্চয়ই আপনার বাংলাদেশের সংবিধান মনে হচ্ছেনা! তবু বলুন শুনি..সংক্ষেপে বলবেন!'
স্যুটকেসটা টেনে দেখিয়ে বললাম,
- 'এর ভিতর ৩০লাখ টাকা আছে। এক অচেনা ভদ্রলোক এটা আমাকে দিয়ে চলে গেছেন। বলেছেন,
"এই টাকাটা নাও। কোন ভালো কাজে লাগিয়ো!" বলেই চলে গেছেন।
এখন এই টাকার মালিকানা অনুসারে আমাকে কি বছরে ইনকাম ট্যাক্স দিতে হবে?'
অফিসার সরু চোখে আমাকে আপাদমস্তক দেখে দারোগাকে ডেকে দু'কাপ চায়ের অর্ডার দিলেন। সাথে এক প্যাকেট ডার্বি।
চা-সিগারেট আসার পর বললেন,
- 'কি করেন?'
- 'ছাত্র. পড়ালেখা করি। তবে মূলত সমাজের খুত বের করার দায়িত্বে ব্যস্ত!'
ঠান্ডা চোখে আমার চোখে চোখ রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
- 'আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন। সরকার আপনার মত মানুষের ট্যাক্সের টাকা খেয়ে হজম করতে পারবেনা।
এবং আশা করি উত্তর পেয়েছেন। ব্যাগ নিয়ে সোজা হাটা শুরু করেন!'
আমি বের হয়ে এলাম।
পিছন থেকে শুনলাম অফিসার কাকে যেনো জলদি তলব করলেন।
সন্তুষ্ট চিত্তে থানা থেকে বের হলাম।
আমার কাজ শেষ!
দ্বিতীয় কাজ,
হাতে ভিজিটিং কার্ড নিয়ে বসে আছি বিশাল ড্রয়িংরুমের এককোণে।
বাড়ির কর্তী, খুটিয়ে খুটিয়ে আমায় দেখছেন।
তারপর জানালেন, যার ঠিকানা/রেফারেন্সে এসেছি আমি টাকা ফেরত দিতে এসেছি, সে আজ থেকে ৩বছর আগে মারা গেছে।
আমি উঠে চলে এলাম।
কিছু কিছু ব্যাপার আগে থেকেই অনুমান করা যায়, যেমন এটা!
সাফারি পরিহিত ভদ্রলোক আমাকে ৩০লক্ষ টাকা দিলেন।
আর আজ শুনছি তিনি ৩বছর আগে মারা গেছেন।
২নং গেট গেলাম।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর পেলাম রুম্পার ঠিকানা।
ঝুপড়ি মত একটা ঘর।
ভেতরে ঢুকে দেখি কাঁথামুড়ি দিয়ে কেউ শুয়ে আছে।
৫মিনিট ডাকাডাকির পর আবিষ্কার করলাম, রুম্পা গায়ে ১০৩' জ্বর নিয়ে কাঁপাকাঁপি করছে।
আলাপ করার সুযোগ আর হলোনা।
সোজা ম্যাট্রোপলিটন হসপিটালে নিতে হলো।
রুম্পার পরিচিত কেউ নেই।
কেবল পাতানো এক সম্পর্ক, ছোট ভাই।
তাকে খোঁজ দিয়ে আনালাম।
৮বছরের এক ছেলে।
স্টেশনে মালপত্তর টানাটানি করে।
কিন্তু যে ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি অবাক লাগলো তা ছেলেটার চেহারা।
ওইটুকুন এক ছেলে। কি দেবদূতের মত চেহারা।
রোদে চামড়া পুড়ে গাড় তামাটে হয়ে গেছে।
মাথায় ঝাকড়া চুল, উস্কোখুস্কো।
গোসল করিয়ে ভালো ড্রেস পড়িয়ে বসালে, একে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের এসির নিচে রাখা বাচ্চাদের চেয়েও সুন্দর দেখাবে!
রুম্পা আমার চাহনি বুঝতে পেরেছে।
- 'পোলাটা এক্কেরে চান্দের লাহান না?? টুকু নাম, আমিই দিছি। আমার ভাই'
অতিরিক্ত সুন্দর জিনিসের দিকে বেশিক্ষণ তাঁকিয়ে থাকতে নেই।
চোখ ফিরিয়ে নিলাম.
- 'তোর নাম টুকু?'
- 'হ'
- 'হ কি রে?? বল, হু'
- 'হু'
- 'আপুকে ভালোবাসিস?'
- 'হ,,,উহু, হু'
- 'যা দেখি কেমন ভালোবাসিস। ৫০০টাকা দিলাম, মোড়ের দোকান থেকে ৩প্যাকেট বিরানি নিয়ে আয়। ১টা ঠান্ডাও আনিস। যাহ'
টুকু বেরিয়ে গেলো টাকাটা দেখতে দেখতে।
আসলে আমি একটা ছোট্ট পরিক্ষা করতে চাইছি টুকুকে।
২০মিনিট পর টুকু ফেরত এলো।
৩প্যাকেট মুরগি-বিরিয়ানি, হাফ লিটারের দুইটা কোকাকোলা আর ফেরত দিলো ১৮০টাকা।
- 'টাকা ঠিকমত গুনে এনেছিসতো?'
- 'হু'
- 'দেখি কেমন গুনলি,,,,,,বিরানি ৮৫টাকা প্যাকেট, আর ঠান্ডা বোতল ৩০টাকা। ৩১৫টাকা খরচা, আর ফেরত দিলি ১৮০টাকা??'
- '৫টাকা হাওয়ায় উইড়া গেছিলো! '
- 'মিথ্যা বলছিস নাতো??'
ভাইকে এভাবে জেরা করতে দেখে রুম্পা প্রথমে অবাক হলেও, এখন ক্ষেপে গেলো!
- 'আপনে আমার টুকুরে চোর ভাবতেছেন?? ৫টেহা চুরি করবো, এত ছ্যাচড়া টুকু না!!'
আমি হেসে উঠে গিয়ে টুকুর বা পায়ের প্যান্টের ভাজ খুললাম।
৫টাকা ভাজ করা বের হলো!
টুকু চোখ, মুখ লাল হয়ে আছে ভয়ে আর লজ্জায়।
আর রুম্পা অবিশ্বাসে হয়ে আছে হা।
কাহিনী আর না বিরানি খেতে দিলাম রুম্পা কে।
আর শাস্তি হিসেবে, টুকুকে না খাইয়ে কান ধরিয়ে রাখলাম বারান্দায়।
একহাতে কান ধরে আছে টুকু, আর অন্য হাতে ঢোলা প্যান্ট ধরে আছে।
বিশ্বাস করতে পারছেনা, যার সুটকেস ভরা এত টাকা সে মাত্র ৫টাকার জন্য এরকম না খাইয়ে কান ধরিয়ে রাখব!
বারান্দায় যারা যাচ্ছে, তারা কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে আমার দিকে।
এতটুকু বাচ্চাকে এমন করছি বলে।
রুম্পাও খাওয়া বাদে গাল ফুলিয়ে বসে আছে।
আমি ভাবছি অন্য কথা।
সব টোকাই পোলাপানের প্যান্ট একসাইজ বড় হয় কেনো??
এটা কি টোকাইদের ট্রেডিশন!
... ... ...
রুম্পাকে টুকুর দায়িত্বে রেখে, স্যুটকেস টানতে টানতে মেসে ফিরলাম।
রুমে এসে পাঞ্জাবী খুলে, একটা তোয়ালে প্যাঁচিয়ে
হারপিক আর ব্রাশ হাতে টয়লেটে গেলাম।
টয়লেট ধোয়ার সেই দুর্বিষহ কাহিনী বলতে চাইনা!
রুমে এসে দেখি প্রতিদিনের মত আজোও চড়ুইটা ঘুলঘুলি থেকে বেরিয়ে আমার জানালার কার্নিশে হাটছে।
ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাঁকিয়ে আবার ময়লা খুঁটে খাওয়া শুরু করলো!
পাত্তাই দিলোনা!!
বুঝেছি, মেসের ম্যানেজার বদরুদ্দিন সাহেবকে জিজ্ঞাস করতে হবে:
'চড়ুইপাখি খাওয়া যায় কিনা'.
রুম্পাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হলো।
কিছুদিন বাড়িতেই থাকবে সে, শরীরের দূর্বলতাটা কাঁটেনি।
তারপর হয়ত আবার নিজ পেশায় ফিরে যেতে হবে।
- 'রুম্পা'
- 'জ্বে ভাইজান'
- 'তোমাকে না বলছি ভাইজান ডাকবা না! নিজেকে বুইড়া বুইড়া মনে হয়'
- 'হিহিহিহি,,,,, আইচ্ছা আইচ্ছা'
- 'হিহিহিহি করে হাসতেও নিষেধ করেছিলাম'
- 'ছুরি,,,ভুইলা গেছিলাম'
বলেই মুখ চেপে আবার হাসতে লাগলো।
কিছু কিছু হাসি আছে, যা দেখলে বুকের ভেতরটা কেমন যেনো মোচড় দিয়ে উঠে!
'হিহিহিহি' অনেকটা সেরকম ১টা হাসি।
তিথীও ওমন হিহিহিহি করেই হাসে।
রুম্পাও ওভাবেই হাসছে।
জগতের সবকটা সুখি মেয়েই বোধহয় 'হিহিহিহি' করেই হাসে।
আচ্ছা আমিতো ১৫লক্ষ টাকার মালিক।
রুম্পার জন্যতো কিছু করাই যায়।
হু,,,রুম্পাকে লাখখানেক টাকা দিয়ে একটা এনজিওর সান্নিধ্যে দিয়ে দিবো।
দেশ আজোও ভালো কিছু উদ্দোগের জন্য টিকে আছে, এই এনজিওগুলো তেমনই!
তবে আপাতত রুম্পাকে তা জানানো যাবেনা।
কেননা, টুকুকে আমি বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি এই খুশি সে এখনোও হজম করতে পারেনি।
নতুন করে খুশীর খবরে, খুশীতে বদহজমি হতে পারে।
আমার এক ছাত্রি আছে, যার খুশির বদহজমি রোগ আছে!
একটুতেই সে খুশি হয়ে যায়।
আর একবার খুশি হলেই, খুশিতে সে হেঁচকি তুলতে থাকে!
হেঁচকি ততক্ষণ চলতে থাকে, যতক্ষণ না সে কোন দু:খের সংবাদ না শুনবে!
সেজন্য আমি একসাথে ২টা নিউজ নিয়ে যাই।
একটা খুশির, একটা দু:খের।
খুশির খবরে হেঁচকি শুরু হলে, দু:খেরটা দিয়ে থামিয়ে দেই!
... ... ...
আপাতত রাত প্রায় ১২টা ছুইছুই।
বাওয়া স্কুলের সামনের যাত্রী ছাউনিতেই আগের রাতের মত চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছি।
হালকা মত তন্দ্রা লেগেছে, এমন সময় বিদঘুটে গন্ধে সেটাও কেঁটে গেলো!
চোখ খুলে দেখি একটা বিলাইছানা চাদরের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। একটু আগে হিসুও করেছে চাদরে।
সেটারই গন্ধ পাচ্ছি!!
হতচ্ছাড়া, কম্ম সাড়ার আর জায়গা পেলোনা?
লাথি মেরে ফেলে দিলাম।
বেঞ্চের আরেককোণে কুইকুই করতে করতে আবার ঘুমিয়ে গেলো!
পাশ ফিরে ঘুরতে দেখি সাফারি পড়া ভদ্রলোক বসে আছেন!
ভদ্রলোক তো না, ভদ্রভুত বলাই উত্তম।
বরাবরের মত শীতের রাতেও ঘামছেন তিনি।
- 'বাবা ভালো আছো'
- 'জ্বী ভালো আছি। আপনি?'
- 'আর বলিওনা, তারাহুরায় কাঁটছে দিন'
- 'আচ্ছা'
- 'তো বাবা টাকাগুলো এনেছো?'
- 'জ্বী,,,,এই নিন স্যুটকেস। ওতে ২৪লক্ষ ৯৪হাজার ৬৭৫টাকা আছে। আর এই নিন খরচার রসিদ:
খরচার খাত : টাকার পরিমান
১. রুম্পার এনজিও বাবদ - ৩লক্ষ টাকা
২. টুকুর বোর্ডিং বাবদ - ২লক্ষ টাকা
৩. হাসপাতাল বাবদ - ৫হাজার টাকা
৪. বিরিয়ানি - ২৫৫ টাকা
৫. কোকাকোলা - ৬০ টাকা
৬. ২কাপ চা - ১০ টাকা
মোট খরচের পরিমান = ৫লক্ষ ৫হাজার ৩২৫টাকা.
ভদ্রভুত মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। বললেন,
- 'ওতে পুরো ৩০লক্ষ টাকাই আছে, আমি জানি'
- 'জ্বী না। ছিলো, এখন নেই। গুনে দেখতে পারেন'
- 'আমি জানি বললাম তো, ওতে ৩০লক্ষই আছে'
- 'আচ্ছা ঠিকাছে, আপনি আপনার স্যুটকেস ধরুন। আর পারলে একটা প্রশ্নের উত্তর দিনতো, "চড়ুইপাখি কি রান্না করে খাওয়া যায়?"
- 'উমম,,, বেশ কঠিন প্রশ্ন তো! হালাল-হারামের ব্যাপার জড়িত।'
- 'আচ্ছা, আপনি জেনে উত্তর দিবেন আমায়'
বলে আবার চাদরে মুখ ঢাকলাম।
খানিকবাদে আবার সেই ফিসফিসানি আওয়াজ, "স্বচ্ছ সাহেব,,,স্বচ্ছ সাহেব শুনছেন..."
চোখ খুলে দেখি বন্দর থানার অফিসার।
- 'আসসালামু আলাইকুম স্যার'
- 'ওয়ালাইকুম আসসালাম'
- 'এতরাতে কি মনে করে? কিছু করেছি আমি?'
- 'নাহ,,এমনি। রুম্পা-টুকু কেমন আছে?'
- 'আপনি ওদের চিনেন কিভাবে?'
- 'মানুষ চেনাইতো আমাদের কাজ'
- 'আচ্ছা'
- 'বিগত দুইদিন আপনার পিছনে চর লাগিয়েছিলাম। আপনি লটারির টিকেট নিয়ে যে কান্ড শুরু করলেন, প্রথমে সন্দেহই হয়েছিলো। কিন্তু এখন একটা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করছে আপমার উপর।
সামান্য একটা প্রস্টিটিউটর আর টোকাইয়ের জন্য যেভাবে নিজের লটারির টাকাটা খরচ করলেন!
রিয়েলি, ইমপ্রেসড আমি'
- 'আমি ঠিক বুঝছিনা। আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে, আমি লটারি পাইনি কোনো,,আসলে____'
- 'থাক স্বচ্ছ সাহেব, বিনয় দেখাতে হবেনা। যথেষ্ট বিনয়ী আপনি।,,,বাহ, পশুপ্রেমীও বটে'
তাকিয়ে দেখি বিলাইটা আবার চাদরের নিচে। কখন এলো টেরই পাইনি!
অফিসারের সাথে কথা শেষ।
যা বললেন তা এখনো জট পাঁকিয়ে আছে!
আমি নাকি লটারিতে ৫লক্ষ টাকা পেয়েছি।
সেই টাকা দিয়েই নাকি এতসব করেছি। উল্টা নিজের পকেট থেকে ৫হাজারের বেশি টাকা খরচ করেছি।
তাহলে গত দুইদিন যে স্যুটকেস নিয়ে হাটলাম, সেটা কোন ভুতে দেয়নি!
কিন্তু এ কিভাবে হয়??
বুঝছিনা,,,,আরোও জট পাঁকাচ্ছে!
- 'স্যার'
- 'বলুন'
- 'সবকটা টোকাইয়ের প্যান্ট ঢোলা কেনো থাকে বলতে পারেন?'
- 'উমম,,, বেশ জটিল প্রশ্ন তো। মানবাধিকারের ব্যাপার আছে!'
- 'আচ্ছা, ভেবে বলবেন আমাকে'
উঠে হাটা শুরু করলাম।
বিলাইটা পিছে পিছে আসছে, আসুক।
সবকিছু তিথীকে জানাতে হবে। ও সুন্দর ব্যাখ্যা দিতে পারবে।
বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে!
ভালোই হলো, বিলাইটা তিথীকে গীফট দেয়া যাবে।
কখনোই তো কিছু দেয়া হয়না।
হাটছি শহুরে ল্যাম্পপোস্ট এর নিচে। সঙ্গে একঝাক ব্যাখ্যাতীত কাহিনী।
উদ্দেশ্য: কোন উদ্দেশ্য নেই।
সবাই যদি উদ্দেশ্যে নিয়েই হাটবে তবে, উদ্দেশ্যহীন হবে কারা?
... ... ...
তারিখঃ ৫১০২/১০/০২
লেখা: রোড নং ছত্রিশ.
Post a Comment