অবয়ব
... ... ...
আজ অনেকদিন পর মানুষটার সাথে দেখা হলো।
বহুদিনের জমানো ক্ষোভ, বেদনা, অভিমান অগ্নুৎপাতের মতো বেরিয়ে আসতে যেয়ে গলার কাছে দলা পাঁকিয়ে আঁটকে গেলো যেনো।
এক নিদারুণ কষ্টের মত অনূভুতিতে শিহরিত হয়ে গেলো গোটা শরীর।
বর্ষার কালো আকাশের দিকে তাঁকিয়ে বৃথা সূর্যের খোঁজ নেবার মতন করে বা হাতে সন্তর্পণে চোখদুটো মুছে বললাম,
'কতদিন পর দেখলাম আপনাকে!'
জবাবে কিছুই এলোনা অপরপক্ষ থেকে...
... ... ...
আমার ডাক নাম অসীম।
আমি আমার মায়ের গর্ভে ৯মাস ছিলাম, তবু নাকি বেশ নাদুসনুদুস হয়েই জন্মেছিলাম। তা দেখে জন্মের পর নানাজান আদর করে ডেকেছিলেন আমায় খলিলুল্লাহ।
নবী ইব্রাহীম আঃ এর উপাধি ছিলো এটা, সেভাবেই আমার নাম রাখা হয় মোঃ ইব্রাহীম হোসেইন খলিলুল্লাহ।
সে যাহোক, স্কুলে ভর্তির প্রথম দিনই নিয়মের খড়গতলে নামের শেষটা কাঁটা গিয়েছিলো আমার।
বাঙালি নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারের একমাত্র ছেলেদের মতন আমিও ছোট থেকে বড় হতে শিখি বাবা-মায়ের অস্ফুট স্বপ্নের দায়িত্বপূরণের বাহক হিসেবে।
স্বভাবতই বেশ কড়া নিয়মেই কেঁটেছিলো শৈশব।
৯ মাস বয়সে হাটতে শিখে যাই, সেই সাথে কথা বলাটাও।
ছেলের এত দ্রুত শিখে ফেলার আগ্রহ দেখেই বুঝি আমার বাবা জীবনের প্রথম বই হিসেবে কিনে আনেন ১টি ইংরেজি ১৩৫ পাতার সম্পুর্ণ গ্রামারবুক।
আমার বাবা নির্ঘাত তার ছেলেকে প্রজিডি ভেবেছিলেন,
সেজন্যই বোধহয় ৪ বছরের ভিতরেই সম্পুর্ণ "অ-আ, A-Z, 1-10(বানানসহ), ১-১০(বানানসহ)" শিখিয়ে পড়িয়ে সোজা ১ম শ্রেণীতে ভর্তি করালেন।
এবং নিয়মের খড়গতলে এসে ভর্তির দিনই আমার নাম থেকে খলিলুল্লাহ কাঁটা পরলো...
ওহ, খানিক আগেই তো এটা বললাম!
সে যাহোক, আমার বাবার অস্ফুট স্বপ্নসমূহের শুরুর দিকে ভালোই যোগান দিতে পারলেও "প্রজিডি" নামক ভুলটা ভাঙাতে আমি বেশি সময় নেইনি।
৫ম শ্রেণীতে বৃত্তি শাখায় থাকা সত্ত্বেও, সমাপনীতে বৃত্তি না এনে দিয়েই আমি সগৌরবের সাথে এটাই প্রমাণ করেছিলাম,
"এ বাঙলায় মধ্যবিত্ত ঘরে প্রজিডিরা জন্মায়না."
অতিশয় দুঃখ এবং বিকট রাগের সাথেই আমায় ৬ষ্ট শ্রেণী থেকে নামি এক হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয় আমার কিঞ্চিতশিক্ষিত বাবা।
তখন আমার বয়স ৯ বছর হলেও, অস্ফুট স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে আমায় ক্লাস করতে হতো ১১/১২ বছরের ছেলেদের সাথে।
ভালো পড়ালেখার মান নিশ্চিত করতে বাবা চলে গেলো ভিন্নশহরে, আমার মা থেকে গেলো বাবার রেখে যাওয়া পরিবার এবং ফেলু প্রজিডিকে দেখভাল করতে।
সে বয়সটাতে না বুঝলেও এখন অনুভব করতে পারি, সপ্তাহের বাজার একা হাতে করাটা একটা মায়ের জন্য কতটা ঝামেলার ছিলো!
অথবা সারাদিন অফিসে কাজ করে রাতে এসে রান্না করে খাওয়াটা একটা বাবার কতটা অসহ্যকর!
আর এদিকে আমি?
বয়সে বড় ছেলেগুলোর সাথে কখনোই খাপ খাইয়ে নিতে পারিনি।
কেননা, "বড়-ছোট" বন্ধুত্বটা খুবই অদ্ভুত হয়। যে বন্ধুত্বে বড়কে মানতে হয় প্রভুগোত্রীয় প্রাণী আর ছোটোর পায়ে থাকে মানিয়ে নেয়ার শেকল।
সে অনূভুতির কথা আমি লিখে বুঝাতে পারছিনা!
আমার বয়োঃসন্ধিকাল হওয়ার দু-তিন বছর আগেই আমি আমার সময়গুলো কাঁটাতাম, একদল পরিপক্ব কিশোরদের মাঝে। কখনো তারা আমায় নিয়ে মজা লুটতো, কখনো বা করুনা।
তবে সবচেয়ে বেশি যেটা পেয়েছি সেটা ছিলো অবহেলা।
বন্ধের দিনে তাই আমি প্রায়ই একা ছিপ নিয়ে বিলে মাছ ধরতে যেতাম।
আমি কখনোই মাছ পেতাম না। কদাচিৎ দু-তিনটা টেংরা বা পুঁটি।
তাই নিয়ে নাঁচতে নাঁচতে বাড়ি ফিরতাম। তবে কোনদিনই সেই মাছ প্লেটে আসেনি আমার।
কেননা, আমার অতিশয় সচেতন মা সন্ধ্যার পর ঘরে ফেরায় সেদিন কুঞ্চি দিয়ে পেটাতো এবং প্যাকেটসমেত মাছগুলো বাড়ির পিছনের আলুশাকের ঝোপে ফেলে দিতো।
সে যাইহোক, এভাবে একা একা কখন যে নিজের বয়োঃসন্ধিকাল পার করেছি নিজেই জানিনা।
বছরের দুই ঈদে বাবা বাড়ি ফিরতো। নতুন অতিথির মতন ব্যবহার করতাম তার সাথে।
সেসময়গুলোতে না বুঝলেও এখন বুঝতে পারি, বাবা-ছেলের মাঝে সম্পর্কের দেয়ালটা সেভাবেই তৈরি হয়েছিলো। যে দেয়াল বছরের পর বছর নতুন ইট, সুড়কি দিয়ে আরোও পাকাপোক্ত করেছি মনের অজান্তেই, কোনদিন ভাঙতে যাইনি।
দোষ দিইনা বাবাকে, তিনি ভেবেছেন অস্ফুট স্বপ্নপূরণের দায়ে এতটুকু ত্যাগ করাই যায়। অথবা ভেবেছেন, আদর দিলে পাছে ছেলে স্বপ্নপূরণ থেকে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে যায়!
আর আমি কি ভেবেছি?... আমি কিছু ভাবতে শিখিনি তখনও।
... ... ...
গর্ভে থেকেই হয়ত উপরওয়ালা ঠিক করে দিয়েছিলেন, আমায় অন্যদের থেকে একধাপ এগিয়ে এগিয়ে ছুটতে হবে।
তাই হয়ত আমি আমার মায়ের গর্ভে ১০মাস থাকিনি, ১মাস আগেই চলে আসি দুনিয়ায়।
জানি, শুরুতেই নিজের সম্পর্কে এই তথ্যটা দিয়েছিলাম। তবু আরেকবার মনে করিয়ে দিলাম, এমনিই কোন কারণ ছাড়া।
এরকম এমনিই এমনিই আমার অনেক কাজ করতে ইচ্ছে করে। এবং করেও ফেলি কাজগুলো। কখনো ফলাফল ভালো আসে, কখনো বা খারাপ,
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোন ফলাফল আসেনা।
প্রথম এই স্বভাবটার সাথে পরিচিত হই ৮ম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষার হলে।
কেনো জানিনা, আমার কিঞ্চিতশিক্ষিত বাবা-মা ধরে নিয়েছিলেন একজন আদর্শ ছেলে মানেই "বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী".
তবে তাদের এই ভুল ভাঙানোর জন্য নয়, গণিত পরীক্ষার হলে বসে এমনি এমনি আমি ২০ নাম্বার না লিখে বেরিয়ে যাই।
কেনো সেদিন এমন করেছিলাম জানিনা।
তবে এটা জানি বৃত্তি শাখার ৩৫ জনের ভিতর সেইবার আমার স্কুলে ২৩টা বৃত্তি এসেছিলো।
হয়ত ২০নাম্বার ছেড়ে না দিলে ২৪টা বৃত্তি হতেই পারতো, কিন্তু কে জানে সেসব!
এরপর আস্তে আস্তে আমার এমনি এমনিই করে ফেলা কাজের পরিমাণ বেড়ে যায়।
তবে ৮ম শ্রেণীতে বৃত্তি না এলেও আমার এই স্বভাবের জন্যই এখন আমি কিবোর্ডের উপর আঙুল চালিয়ে শব্দগুলো লিখতে পারছি। সে যাহোক..
... ... ...
আজ আমি ২৮।
আজ অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এসে নিজেকে খুব বেশি অভিজ্ঞ মনে হয়না।
নিজের ছেলেবেলা হাতড়াতে গিয়ে আজ আমি তেমন কিছুই পাইনা, হয়ত এটাও অনভিজ্ঞ ভাবার একটা কারণ হতে পারে।
আমার মা এখন আমার সাথেই থাকে। আর বাবা?
আমার বাবাকে আমি শেষ দেখেছিলাম এয়ারপোর্টে।
বিদায় জানাতে এসে বলেছিলেন,
"মায়ের খেয়াল রাখিস। মাঝেমাঝে খবর দিস মনে করে, আর সাবধানে থাকিস"
আরোও কিছু বলেছিলেন, মনে করতে পারছিনা সেসব।
বিদায়বেলা মন খারাপও হয়নি কেনো জানিনা, এমনি এমনি কাঁদতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। তবে আমার বাবা পেরেছিলেন।
তিনি কোন কারণ ছাড়াই সেদিন এমনি এমনি কেঁদে এয়ারপোর্টের লোকেদের সামনে আমায় লজ্জ্বায় ফেলেছিলেন।
আর আমার মা?...জানিনা, তিনি তখন অন্যদিকে তাঁকিয়ে ছিলেন।
কলেজে থাকাবস্থায় আমার বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে যায়।
আমার বাবা-মা আলাদা হয়ে গেলেও, আমি থেকে যাই মায়ের সাথে।
কেনো তারা এমনটা করেছিলো জানিনা, তবে আলাদা হওয়ার পরেও আমার কিঞ্চিতশিক্ষিত বাবা প্রতিমাসের খরচ আমাদের পাঠিয়ে দিতো ঠিক যেমন ক্লাস সিক্সে থাকার সময় দিতো।
তবে এবারের তফাতটা ছিলো, বছরের দুই ঈদে বাবা আর আসতো না।
... ... ...
আমি কতটুকু বড় হয়েছি জানিনা তবে,
বিদেশে এসে আমিও আমার বাবার মত দায়িত্ব পালন করতে থাকি।
আমার বাবা নিবেনা জেনেও, প্রতিমাসে এমনি এমনি আমি টাকা পাঠিয়েছি।
আমার মা অবশ্য তা জানেনা।
আমি জানিনা আমি কতটুকু কি করতে পেরেছি,
তবে আমি আমার বাবার অস্ফুট স্বপ্নগুলো কোনদিন পূরণ করে দিতে পারিনি। আমি জানিইনা, স্বপ্নগুলো কি ছিলো!
হয়ত যদি কোনদিন নিজে বাবা হই সেদিন জেনে যাবো।
আসলে আমার বাবা আজ মারা গিয়েছেন। কোনকারণ ছাড়াই এমনি এমনি তিনি হুট করে চলে গেলেন।
আমি কখনো তাকে বলতেও পারিনি, আমি জানিনা, "বাবা আপনি কেমন?"
আমি কখনো তার সাথে সহজভাবে মিশতেও পারিনি।
আমি জানিনা, বাবা বোধগুলো কেমন।
আমি কেবল জেনেছি, বাবা মানে দায়িত্ব।
বাবা মানে ত্যাগ। বাবা মানে নীরবতা। বাবা মানে এক আবছায়া চরিত্র।
মৃত বাবার পাশে দাড়িয়েও আমি বুঝতে পারছিনা আমার কি করনীয়!
পৃথিবীর প্রতিটি বাবাই কি এমন হয়?
নাকি কেবল আমিই পারিনি বাবাকে বুঝতে।
...হয়ত আমি আমার বাবার এক ব্যর্থ প্রজিডি।
... ... ...
তারিখ: ৭১০২/৭০/১৩
লেখা: রোড নং ছত্রিশ.
Post a Comment